সমুদ্রস্রোত

🌐 সমুদ্র স্রোত - ধারণা ও প্রকারভেদ :পৃথিবীর আবর্তন গতি, বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্র জলে লবণতা, ঘনত্ব ও উষ্ণতার তারতম্যের জন্য সমুদ্রের কতকগুলি নির্দিষ্ট অংশের জল প্রতিনিয়ত নির্দিষ্ট দিকে প্রবাহিত হয়। সমুদ্র জলের এই প্রবাহ বা গতিকেই বলে সমুদ্রস্রোত।

 অন্যদিকে, সমুদ্রে যে ঢেউ ওঠে তাতে জলরাশি কোনো দিকে প্রবাহিত হয় না, একজায়গাতেই ওঠানামা করে।একে বলে সমুদ্র তরঙ্গ।


🌐সমুদ্রস্রোতের প্রকারভেদ: সমুদ্রস্রোত দু-প্রকারের-—

উষ্ণ স্রোত:   উষ্ণ মন্ডলের  উষ্ণ ও হালকা   জল      পৃষ্ঠপ্রবাহরূপে সমূদ্রের ওপর অংশ দিয়ে শীতল মেরুপ্রদেশের দিকে বয়ে যায় ।  এর নাম উষ্ণ স্রোত।

 ◉ শীতল স্রোত:  উষ্ণমণ্ডলের জলের এই অভাব পূরণের জন্য মেরু অঞ্চলের শীতল ও ভারী জল সমুদ্রের নিম্নাংশ দিয়ে।অন্তঃপ্রবাহৰূপে উষ্ণমণ্ডলের দিকে বয়ে যায়। এর নাম শীতল স্রোত। 


 🌐সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির কারণ: সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির উল্লেখযোগ্য কারণগুলি হল—

🍥পৃথিবীর আবর্তন: পৃথিবী তার নিজের অক্ষের ওপর আবর্তন করায় যে কোরিওলিস বলের (Coriolis force) উৎপন্থি হয়, তার প্রভাবে সমুদ্রস্রোতও সোজাপথে প্রবাহিত হতে পারে না। ফেরেলের সূত্র অনুসরণ করে উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে বেঁকে সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়। 

🍥বায়ুপ্রবাহ: অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মতে সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির প্রধান কারণ হলো বায়ুপ্রবাহ। তাই সমুদ্রের উপর দিয়ে বায়ু যে দিকে প্রবাহিত হয়, সেইদিকেই সমুদ্রের উপরকার জলরাশিকে টেনে নিয়ে যায় । যেমন—

(i) যেসব স্থানে আয়ন বায়ু প্রবাহিত হয়, সেখানে সমুদ্রস্রোত বায়ুপ্রবাহের দিকে সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উত্তর গোলার্ধে উত্তর-পূর্ব দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়।

(ii) আবার পশ্চিমবঙ্গ বায়ু অধ্যুষিত অঞ্চলে সমুদ্রস্রোত পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। 

(iii) মেরু বায়ু পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়।

🍥 সমুদ্র জলের উষ্ণতার তারতম্য: উষ্ণ মন্ডলের সমুদ্র জল বেশি পরিমাণে উষ্ণ হয়ে পৃষ্ঠপ্রবাহ রূপে দুই মেরুর দিকে প্রবাহিত হয়। জলের এই অভাব পূরণের জন্য মেরু অঞ্চলের শীতল জল অন্তঃপ্রবাহ রূপে উষ্ণ মণ্ডলের দিকে বয়ে আসে।

🍥 সমুদ্র জলের লবনতার তারতম্য: সমুদ্র জলে লবণের পরিমাণ কোথায় কম, কোথায় বেশি। কম লবণাক্ত জল হালকা বলে সমুদ্রের উপরে অংশ দিয়ে পৃষ্ঠপ্রবাহ রূপে বয়ে যায়। জলের এই অভাব পূরণের জন্য বেশি লবণাক্ত ও ভারী জল সমুদ্রের নিম্নাংশ দিয়ে অন্তঃপ্রবাহ রূপে ওই কম লবণাক্ত অঞ্চলের দিকে বয়ে আছে।

🍥 সমুদ্রজলের ঘনত্ব: সমুদ্র জলের ঘনত্ব প্রধানত উষ্ণতা, লবণতা ও বায়ুমণ্ডলীয় চাপের উপর নির্ভরশীল। সমুদ্র জলের ঘনত্ব বেশি হলে ওই জল অন্তঃপ্রবাহ রূপে কম ঘনত্ব যুক্ত জলের দিকে প্রবাহিত হয় আর কম ঘনত্ব যুক্ত জল পৃষ্ঠপ্রবাহ রূপে বেশি ঘনত্ব যুক্ত জলের দিকে প্রবাহিত হয়।

🍥 বরফের গলন: দুই মেরু সংলগ্ন সমুদ্রে বিপুল পরিমাণে বরফ গলে জলে মেশে। এজন্য সেখানে জলের পরিমাণ বেড়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ উঁচু হয়ে যায় এবং সমুদ্র জলের লবনতা হ্রাস পায়। উভয় কারণেই সমুদ্র জল স্থানান্তরিত হয় বলে স্রোত সৃষ্টি হয়।

🍥 উপকূলের আকৃতি: সমুদ্রস্রোত মহাদেশগুলি যে উপকূল প্রান্তে বাধা পায়, সেখানকার গঠন বা আকৃতি অনুসারে সমুদ্র স্রোতের গতিপথ পরিবর্তিত হয় বা বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়।

🍥 ঋতুভেদ: কখনো- কখনো ঋতু অনুসারে বছরের বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয়। ফলে ঋতু অনুসারে সমুদ্র স্রোতেরও দিক পরিবর্তন হয়। যেমন— ভারত মহাসাগরে প্রবাহিত মৌসুমী স্রোত গ্রীষ্মকালে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে দক্ষিণাবর্তে বা ডানদিকে বয়ে যায়। শীতকালে এই স্রোতটিই আবার উত্তর-পূর্ব মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে ঠিক বিপরীত দিকে অর্থাৎ বামদিকে থেকে বয়ে যায়।          এগুলি ছাড়াও—

🍥 সামুদ্রিক শৈলশিরা উপস্থিতি।

🍥 বাষ্পীভবন।

🍥 বায়ু চাপের তারতমের জন্যও সমুদ্রস্র সৃষ্টি হয়।


🌐 সমুদ্রস্রোতের প্রভাব: জীবনের উপর সমুদ্র স্রোতের বিভিন্ন প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ।যেমন—

🚢 মগ্ন চলার সৃষ্টি ও তার বাণিজ্যিক গুরুত্ব: শীতল স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসা হিমশৈল উষ্ণ স্রোতের সংস্পর্শে এসে গলে যায়। ফলে হিমশৈলের মধ্যে থাকা পাথর, বালি, প্রভৃতি সমুদ্র বক্ষে দীর্ঘকাল ধরে জমতে জমতে উঁচু হয়ে মগ্নতারা সৃষ্টি করে। যেমন নিউফাউন্ডল্যান্ডের অদূরে গ্র্যান্ড ব্যাংক,  জর্জেস ব্যাংক প্রভৃতি এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের কাছে ডগার্স ব্যাঙ্ক, রকফল ব্যাংক উল্লেখযোগ্য মগ্নচড়া। গভীরতা কম বলে সূর্যলোক সহজে সমুদ্র তলেদেশে পৌঁছে যায়, যা মাছের খাদ্য উদ্ভিদ ও প্রাণি প্ল্যান্টন সৃষ্টির পক্ষে আদর্শ। এজন্য এসব মগ্নচড়া অঞ্চলে প্ল্যানটন ও মৎসের সমাবেশ ঘটে এবং এলাকাগুলি বাণিজ্যিক মৎস্যক্ষেত্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

🚢 উপকূলের জলবায়ু: ◉সমুদ্রস্রোত যে উপকূলের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয় সেখানকার জলবায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন –শীতল ল্যাব্রাডর প্রভাবে নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে বায়ুর উষ্ণতা কমে এবং উষ্ণ কুরোশিও স্রোতের প্রভাবে জাপানের পশ্চিম উপকূলে বায়ুর উষ্ণতা বাড়ে।

                                    আবার উষ্ণ স্রোতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ুতে জলীয় বাষ্প থাকে বলে ওই বায়ু স্থলভাগের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলে বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু শীতল স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু শুষ্ক বলে বৃষ্টিপাত হয় না। আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে নামিবিয়া উপকূলে এই কারণে মরুভূমি সৃষ্টি হয়েছে।

                                  সাধারণত যেসব অঞ্চলে উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলন ঘটে, সেখানে উষ্ণতার পার্থক্যের জন্য ঘন কুয়াশা এবং প্রবল ঝড় ঝঞ্ঝা হয়। ফলে জাহাজ বা বিমান চলাচলে অসুবিধা সৃষ্টি হয়। যেমন নিউফাউন্ডল্যান্ড উপকূল।

   


🚢 জলবায়ুর পরিবর্তন: বর্তমানে বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তনের সমুদ্রস্রোতের ভূমিকা ও লক্ষ্য করা যায়। যেমন- বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে সামগ্রিকভাবে সমুদ্র জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে উষ্ণ স্রোতের ওপর সৃষ্ট প্রবল ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়, যেমন- সাইক্লোন, হারিকেন, টাইফুন, উইলি উইলি প্রভৃতির সংখ্যা এবং তীব্রতা অনেক বেড়েছে। আবার উষ্ণ সমুদ্র স্রোতের ওপর জলের বাষ্পীভবন বৃদ্ধি পাওয়ায় সংলগ্ন স্থলভাগে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। এছাড়া পেরুর উপকূলে উষ্ণ সমুদ্রস্রত -সৃষ্ট 'এল নিনোর' আবির্ভাব ও স্থায়িত্ব যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমন প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তে 'লা নিনা' র আবির্ভাবের ক্ষেত্রে অনেক অস্বাভাবিকতা সৃষ্টি হয়েছে। আর এর ফলে ভারত সহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেও বৃষ্টিপাতের অনিশ্চয়তা অনেক বেড়েছে।

Comments

Popular posts from this blog

ভারতের কৃষি

শিলা (Rocks)