আবহবিকার
🪨 ভূমিকা: আবহাওয়া (weather) থেকেই আবহবিকার (weathering) কথাটির উৎপত্তি হয়েছে। আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের সাহায্যে ভূপৃষ্ঠের নানা রকমের 'বিকার' বা পরিবর্তনকে আবহবিকার বলা হয়।
☛ সংজ্ঞা: যখন আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান (যেমন- বায়ুর উষ্ণতা, বৃষ্টিপাত, আর্দ্রতা প্রভৃতি) দ্বারা ভূত্বকের উপরিভাগের শিলাস্তরসমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মূল শিলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অবস্থান করে তাকে বলে আবহবিকার।
প্রকৃতপক্ষে, আবহবিকার হল একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ভূত্বকের উপরিভাগে শিলাসমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। এজন্য আবহবিকারের আরেক নাম বিচূর্ণীভবন(Disintegration)।
🪨 আবহবিকারের প্রকারভেদ: আবহবিকার প্রধানত তিন প্রকার—
A. যান্ত্রিক বা ভৌত আবহবিকার।
B. রাসায়নিক আবহবিকার।
C. জৈব- রাসায়নিক আবহবিকার।
◉ যান্ত্রিক বা ভৌত আবহবিকার:
☛ সংজ্ঞা: তাপমাত্রা দ্রুত পরিবর্তন, কেলাস গঠন, শিলাস্তরের চাপের হ্রাস- বৃদ্ধি কীটপতঙ্গের জৈবিক কার্যাবলী প্রভৃতির প্রভাবে যান্ত্রিক বা ভৌত পরিবর্তন ঘটলে শিলাসমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। একে বলে যান্ত্রিক বা ভৌত আবহবিকার। এইভাবে শিলা শুধু ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত হয়, শিলার বিভিন্ন উপাদানের মূল ধর্ম একই থাকে।
☛ বিভিন্ন প্রক্রিয়া: যান্ত্রিক আবহবিকার এর পাঁচটি প্রক্রিয়া হল—
1. তাপমাত্রা দ্রুত পরিবর্তনের প্রভাবে উষ্ণ মরু অঞ্চলে গ্রানাইটের মত এক জাতীয় খনিজে গঠিত শিলার বাইরের অংশ স্তরে স্তরে খুলে আসে। একে বলে গোলাকৃতি আবহবিকার শল্কমোচন।
1. কেলাস গঠনের কারণেও শিলাচূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। যেমন শীতল অঞ্চলে শিলাস্তরের ফাটলে জল ঢুকে বরফে পরিণত হলে ফাটলের আয়তন বাড়ে এবং তার চাপে শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় একে বলে তুহিন খন্ডিকরন।
3. শিতপ্রধান অঞ্চলে ভূমির উপর সঞ্চিত বিপুল পরিমাণে বরকের স্তূপ অপসারিত হলে নিচের শিলাস্তর চাপমুক্তির কারণে প্রসারিত হয়ে খন্ড বিখণ্ড হয়ে যায়। একে বলে শিটিং।
4. বৃষ্টির ক্রমাগত আঘাতে দুর্বল হয়ে বা বৃষ্টির জলের সংস্পর্শে শিলাস্থিত খনিজ পদার্থের আয়তন বেড়ে শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।
5. শিলাস্তরের ফাটলে গাছের শিকড় প্রবেশ করলে কাল ক্রমে তার চাপেও শীলা খন্ডবিখন্ড হয়ে যায়।
◉ রাসায়নিক আবহবিকার:
☛ সংজ্ঞা: বায়ুমণ্ডলের মধ্যে যে অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, জলীয় বাষ্প প্রভৃতি উপাদান থাকে, সেগুলি শিলার মধ্যে থাকা খনিজ পদার্থের ওপর বিভিন্নভাবে বিক্রিয়া করে শিলার কাঠিন্য নষ্ট করে দেয়। এই বিক্রিয়ার জন্য শিলার মূল খনিজ গুলো গৌণ খনিজকনায় পরিণত হয়ে সহজেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এইভাবে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হলে তাকে রাসায়নিক আবহবিকার বলে।
☛ বিভিন্ন প্রক্রিয়া: রাসায়নিক আবহবিকারের পাঁচটি প্রক্রিয়া হল—
1. চুনাপাথর গঠিত অঞ্চলে বৃষ্টির জলের মাধ্যমে যে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয় তাকে বলে অঙ্গারযোজন বা কার্বোনেশন । এইভাবে চুনাপাথর দ্রবীভূত হয় বা গলে যায়।
2. যেসব শিলায় লোহার ভাগ বেশি সেগুলি জলের মধ্যে দ্রবীভূত অবস্থায় থাকা অক্সিজেন সংস্পর্শে এসে দ্রুত ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, একে বলে জারণ বা অক্সিডেশন।
3. কতগুলি শিলা গঠনকারী খনিজের জল শোষণ করার ক্ষমতা বেশি, যেমন- হেমাটাইট, পলিভিন প্রভৃতি এইসব খনিজের সঙ্গে জল যুক্ত হলে শিলার রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, একে বলে জল যোজন বা হাইড্রেশন। এর ফলে শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
4. জলের মধ্যে থাকা হাইড্রোজেনের হাইড্রোক্সিল আয়ন শিলা স্থিত খনিজের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়ার যে পরিবর্তন ঘটায় তা হল, আদ্র বিশ্লেষণ বা হাইড্রোলিসিস। এতে শিলার ক্ষয় ঘটে।
5. জিপসাম, খনিজ লবণ প্রভৃতি শীলা জলে দ্রবীভূত হলে বিয়োজিত হয়, একে বলে দ্রবণ।
◉ জৈব- রাসায়নিক আবহবিকার:
☛ সংজ্ঞা: গাছের ডাল, পাতা, ফুল, ফল, শিকড়, কীটপতঙ্গ প্রভৃতি পচে যে জৈবিক অম্ল সৃষ্টি হয়, তা শিলার বিয়োজনে সাহায্য করে। একে জৈব- রাসায়নিক আবহবিকার বলে।
যেমন— জৈবিক অম্লের মাধ্যমে ব্যাসল্ট শিলার বিয়োজন ঘটে এবং কৃষ্ণ মৃত্তিকা সৃষ্টি হয়। উল্লেখিত যান্ত্রিক, রাসায়নিক এবং জৈব-রাসায়নিক আবহবিকার এর মাধ্যমে ভূত্বকের উপরিভাগের শিলাস্তর চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ভূমির ওপর শিথিল, কোমল ও সমধরনের পদার্থের আবরণ বা রেগোলিথ সৃষ্টি করে। এই রেগোলিথ থেকেই সৃষ্টি হয় মৃত্তিকা। এরপর মৃত্তিকা সহ শিলাস্তরের ওপর সৃষ্ট ওইসব পদার্থ নদী, হিমবাহ, বায়ু প্রবাহ প্রভৃতির মাধ্যমে অন্যত্র অপসারিত বা পরিবাহিত হয়। আবার ওইসব বিচূর্ণকৃত পদার্থসমূহই নদী, হিমবাহ, বায়ুপ্রবাহের মাধ্যমে নিম্নভূমিতে সঞ্চিত হয় অর্থাৎ অবরোহন প্রক্রিয়াতেও আবহবিকারের এক উল্লেখযোগ্য অবদান থাকে।
Comments
Post a Comment